আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশের ভারত নীতি: অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৫ ২২:২১

এখন সময় সম্পর্ক গঠনের, যেখানে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে বলবে: আমরা স্বাধীন, আমরা সার্বভৌম।

মতামতের কলাম :   বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নানা পর্যায়ে ভারতের সাথে সম্পর্কের রূপ বদলেছে। তবে গত পনেরো বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই সম্পর্ক এক অস্বাভাবিক নির্ভরশীলতায় পরিণত হয়েছিল। পলাতক স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশ কার্যত ভারতের করদরাজ্যে পরিণত হয়। নামমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র থাকলেও বাস্তবে দেশের রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, সামরিক বাহিনী, সিভিল প্রশাসন, পুলিশ, আদালত, সবকিছুই চলতো দিল্লির ইশারায়। সার্বভৌমত্ব ছিল কাগজে-কলমে; বাস্তবে বাংলাদেশ ছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত এক পরাধীন উপনিবেশ। কিন্তু চব্বিশের জুলাইয়ের বিপ্লব এই বাস্তবতাকে বদলে দেয়। দীর্ঘ পনেরো বছর মামলা-হামলা, গুম-খুন, নির্যাতনের শিকার জনগণ যখন ক্ষোভে ফুঁসে উঠছিল, তখনই ছাত্রদের ন্যায্য কোটা সংস্কার আন্দোলনে ফ্যাসিবাদী সরকারের নির্বিচার দমন-পীড়ন পুরো জাতিকে রাস্তায় নামিয়ে আনে। জনগণের প্রতিরোধ ও ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত শক্তিতে স্বৈরাচারী সরকার পতিত হয়, এবং শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। এটি বিশ্ব ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত, যেখানে সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এমপি-মন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা এমনকি বাইতুল মুকাররমের নিযুক্ত ইমাম পর্যন্ত পালিয়ে যান। একইসাথে বাংলাদেশের মাটিতে ভারতীয় আধিপত্যবাদেরও পতন ঘটে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ভারতের আচরণে এক ধরনের নেতিবাচকতা লক্ষ্য করা যায়। সম্পর্কের স্বাভাবিক গতি না রেখে ভারত বরং অসহযোগিতা শুরু করে। তাদের গণমাধ্যমে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কল্পিত ও বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রচার হয়; এমনকি বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা প্রদানও স্থগিত করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সরকার চুপ করে বসে থাকেনি। ভারতীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীন ও স্বার্থভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এটি সহজ কাজ ছিল না, কারণ গত পনেরো বছরে রাষ্ট্রের প্রায় সব খাতেই ভারতীয় ঘনিষ্ঠদের অবস্থান শক্ত করা হয়েছিল। তবু সরকার ধীরে ধীরে সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপ তারই প্রমাণ, ফেনীতে ভারতের ইপিজেড স্থাপনের জন্য বরাদ্দকৃত ৯০০ একর জমি বাতিল করা হয়েছে; গুম-খুনে জড়িত সেনা ও পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচারাধীন করা হয়েছে। প্রতিরক্ষা খাতেও বড় পরিবর্তন আসছে, চীন, ইতালি ও পাকিস্তান থেকে মাল্টি-রোল কম্ব্যাট এয়ারক্রাফট এবং তুরস্ক থেকে আক্রমণাত্মক হেলিকপ্টার ও এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসবই ইঙ্গিত দেয় যে, বাংলাদেশ এখন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এক সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়াচ্ছে। ভবিষ্যতের দিকেও আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক পারস্পরিক সম্মান ও স্বার্থের ভিত্তিতেই গড়ে তোলা হবে। তিনি স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, জনগণের মনোভাবের বাইরে গিয়ে তিনি কোনো নীতি গ্রহণ করবেন না। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, আসন্ন নির্বাচনে বিএনপিই সরকার গঠন করবে। আর যদি জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন জোটও ক্ষমতায় আসে, তবুও বাংলাদেশের ভারত নীতিতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। উভয় পক্ষই সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক স্থাপনেই আগ্রহী। সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশ এখন আর কোনো দেশের ছায়ায় নয়, বরং নিজের স্বার্থ, মর্যাদা ও জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে এগিয়ে চলেছে। ভারতীয় আধিপত্যবাদের অধ্যায় বাংলাদেশের মাটি থেকে ইতিহাসে স্থান নিয়েছে। এখন সময় নতুন এক সমমর্যাদার সম্পর্ক গঠনের, যেখানে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে বলবে: আমরা স্বাধীন, আমরা সার্বভৌম।

মীর জাহান,ফ্রান্স প্রবাসী,অনলাইন একক্টিভিষ্ট,উপদেষ্টা সম্পাদক বার্তা সিলেট ডট কম।

আন্তর্জাতিক থেকে আরো পড়ুন